বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় মেয়েটি।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে সোহান।কি করছে মেয়েটি আর মেয়েটিই বা কে?
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সোহান।
কে আপনি? কি করছেন?
আমাকে বাঁচান আপনি।প্লিজ দরজা খুলবেননা।
কি হয়েছে? আপনি দরজা লাগাইছেন কেন?
মেয়েটি সোহানের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,প্লিজ আপনি দরজা খুলিয়েন না ওরা আমাকে বাঁচতে দিবেনা।
ওরা কারা?
মেয়েটি সে কথার জবাব না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে প্লিজ আমাকে একটু আশ্রয় দিন।
কিন্তু আপনি কে ? আপনি শান্ত হোন।
বাড়িতে সোহান একা। আবিবাহিত একজন পুরুষের ঘরে অপরিচিত এক মেয়ে,আবার দরজা বন্ধ। কি হবে---ভেবে পায়না সোহান। উচ্চস্বরেও কথা বলতে ভয় পায় সে,মেয়েটি যদি কোন সিনক্রিয়েট করে ফেলে।
আমাকে একটু ভিতরের ঘরে নিয়ে চলুন।
না এখানেই আপনি বসুন। আমি একা বাড়িতে থাকি।অবিবাহিত। তারপর একটু থেমে বলে ,আপনার কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেইতো?
না আমি বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।ওরা চলে গেলে আমি একটু পরেই চলে যাব।
ওরা কারা ? বলছেন না কেন, ওরা কারা?
ওরা মিডিয়ার কর্মী,সাংবাদিক।
আপনি এখন বলুন, ওরা কি চায় আপনার কাছে?
ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢোকে মেযেটি।
সোহান বাধা দেয়।
সে বাধা না মেনে চলে যায় মেয়েটি ভিতরের ঘরে।
মেয়েটির চেহারাই বলে দিচ্ছে সে ভয়ানক বিপদে পড়েছে।সোহান পিছু পিছু ভেতরের ঘরে ঢোকে।
মেয়েটি বিছানায় বসে পড়ে।গায়ের চাদরটা বিছানায় রাখে।সাথের হ্যান্ডব্যাগটিও।
মেয়েটি বেশ সুন্দর দেখতে।বয়স কত হবে ১৮ কি ১৯।কিংবা বড়জোর কুড়ি।চোখ দুটো বেশ আকর্ষনীয়..।কি ভাবছে এসব সোহান।নিজেকেই ধিক্কার দেয়।পুরো বাড়িতে সে আর মেয়েটি একা। মেয়েটি তার কাছে আশ্রয় চাইছে।কিসের আশ্রয় ? সে কি এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির পাশে বসবে।তার হাতদুটো ধরবে।ছিঃ ছিঃ কি অসভ্য চিন্তা।সে একটা এনজিওতে চাকরী করে।সে এমন কি সব বাজে চিন্তা করছে।
বরঞ্চ তার উচিত মেয়েটিকে বিপদ হতে উদ্ধার করা। মেয়েটি ভয়ে, কষ্টে সংকুচিত হয়ে বিছানার এককোনে বসে আছে।
কি ব্যাপার আপনার কি হয়েছে, কিছুই যে বলছেননা।দেখুন আপনি এখানে থাকলে আমার বিপদ হতে পারে।
কি বারবার একই কথা বলছেন!আমিতো বলেছি চলে যাব।মেয়েটি বেশ জোরে কথাটি বলে।
এখানে কেউ আসবে না। এবার বলুন আপনার কি হয়েছে।আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।
বিশ্বাস করেছি বলেইতো এখানে আশ্রয় চেয়েছি।
আপনি বলুন আপনি কে?আর কেনইবা ওরা আপনার পিছু নিয়েছে।
ওরা আমার ইন্টারভিউ নিতে চায়।
কেন? কিসের ইন্টারভিউ?
ওরা জানেনা বোঝেনা একটা মেয়ের কত কষ্ট।ওরা আমার কষ্ট বাড়িয়ে দিতে চায়।
আমিতো কিছুই বুঝছি না। আপনি আমাকে সব খুলে বলুন।
কিন্তু ওরা যদি এসে পড়ে,আমায় নিয়ে যেতে চায়।
আমি আপনার কথা না শুনলেতো কিছুই বলতে পারবো না। কিছুই করতে পারবো না।
বেশ শুনুন তাহলে----
ওরা তিনজন্ উঃ মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে মেয়েটি।
এগিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সোহান!সে বলে,বুঝতে পারছি না আমার শোনা উচিত হবে কিনা!তবুও বলছি মনে হয় আপনার কষ্ট হয়তো কমে যাবে..
-কষ্ট কষ্টতো বেড়েই চলেছে।আমি ঘুমাতে পারি না,কি ভয়ংকর মানুষগুলো এ সমাজের।নারী হয়ে জন্মেছি বলেই কি পাপটাই না করেছি।যেন সব দোষ আমার।আমি কেন ঠিক হয়ে চলতে পারিনা, বাসায় বসে থাকতে পারিনা,পাড়ার প্রভাবশালী মুরুব্বীদের কতই না উপদেশ।সেই সব দুষ্ট ছেলেদের পক্ষে কতই না সাফাই, এ বয়সে একটু আধটু ওরকম করবেই ওরা,না হলে ছেলে হবে কেন ?আর তাইতো মুরুব্বীদের আস্কারা পেয়েই না তারা..
বলুন থামলেন কেন?
সেই পাষন্ডগুলো যারা আমার ইজ্জত লুট করল,আমায় রক্তাক্ত করল---
ঐ ডাক্তার,যে আমায় পরীক্ষা করল । উঃ কি লজ্জা... খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা---এটা কি যৌন নির্যাতন নয়?
কি জবাব দেবে সোহান। সে চুপ করে থাকে।
বলতে থাকে মেয়েটি-সাংবাদিকেরা আমায় প্রশ্ন করে আমার জীবনটাকে অসহনীয় করে তুলেছে।কিছু কিছু সাংবাদিক এমন সব প্রশ্ন করে যেন তারা মজা লুটছে।কিভাবে হল,কখন হল,ওদের চিনেছেন কিনা,কজন ছিল---ভাবতে পারেন এভাবে একটা নির্য়াতিত মেয়েকে নিয়ে সবাই উপহাস করতে লাগল। এটা কি কোন সভ্য সমাজ হল?আমার বাবামার সামনে কত প্রশ্ন করা হল।প্রশ্নের পর প্রশ্ন।পত্রিকায় নাম ছবি প্রকাশ হল।
একটু থেমে নেয় মেয়েটি,কাদের নাম ,ছবি প্রকাশ হল জানতে চাইলেন না।
পত্রিকাওযালারা আমার নাম ছবি ঠিকানা ছাপিয়ে দিল।
থানায় ধর্ষন মামলা হল। পুলিশ সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল,যেন অনেক মজা পাচ্ছে। এরকম কাহিনী কোনদিন শোনেনি। কিংবা কল্পনায় সে সুখ পেতে থাকল।
কোর্টে মামলা উঠল। উকিলের জেরা চলতে থাকল,কোর্ট ভর্তি মানুষের সামনে কতইনা প্রশ্ন।যতটা না দোষীদের শাস্তি দেয়ার চেষ্টা তার চাইতে বিনোদন দেয়ার চেষ্টা।তাদের কে হাত ধরেছিল,কাপড় কে খুলেছিল,আপনি কি করছিলেন সে সময়...উঃ লজ্জ্য় মরে যেতে ইচ্ছে হয়।মনে হয় তখন মরে যাইনি কেন?
কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে উঠে মেয়েটি,এখন আপনি বলুর আমি কোথায় যাব? এ সমাজ কিভাবে সে মেয়েটিকে মানসম্মানের সাথে বাঁচিয়ে রাখবে।তাইতো কতইনা মেয়ে আত্মহত্যা করে ।নির্যাতিত মেয়ের কষ্টটা কেউ বুঝতে চায়না। না সমাজ,না বাষ্ট্র।
তারপর একটু থেমে নেয় মেয়েটি।আবার বলতে শুরু করে,
ঐ যে ওরা আসছে বলছিলামনা। ওরা সংবাদকমর্ী।পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য ,মিডিয়ার প্রচারের জন্য আমার পিছনে ছুটে আসছে।
এতক্ষনে মুখ খুলে সোহান,আপনার ভালর জন্যই হয়তো তারা ফলোআপ করতে আসছে---
ভালো?হয়তো।আমি সব সাংবাদিককে দোষ দিচ্ছি না্ ।কিন্তু তারা আমার কাছে আসছে কেন?তারা সেইসব পাষন্ডদের যারা মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করছে তাদের পিছনে ছুটে বেড়াক,তারা কোথায়,কে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে,পুলিশ কেন তাদের ধরছে না সেগুলো প্রকাশ করুক। সেইসব উকিল বিচারকদের মুখোশ খুলে দিক যারা প্রভাবশালীদের বাঁচাতে নিরীহ নিরপরাধ মেয়েদের নষ্ট চরিত্র,পতিতা বলে অপবাদ দিতে কুন্ঠাবোধ করে না।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়।মেয়েটি অাঁতকে উঠে।
প্লিজ দরজা খুলবেন না। ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না।
দরজায় অনবরত কড়া পড়ছে।
সোহান বলে,আপনি বাথরুমে ঢুকুন।আমি দেখছি।বাইরের ঘরে এসে দরজা খোলে সোহান।
চমকে যায় সে।আরে অনিক তুই?
হ্যা কেমন আছিস?একটা নিউজ কাভার করতে এসেছিলাম তাই ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই্
অনিকের সাথে আরও তিনজন লোক।সোহান বলে এরা কারা?
ওরাও মিডিয়ার রিপোর্টার।কি বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি না ভিতরে বসতে বলবি।
ইতস্ততঃ করতে থাকে সোহান।না মানে ---সোহানকে সরিয়ে ভেতরে ঢোকে অনীক ও অন্যরা।
একটু বাথরুমে যাব।অনীক বলে।
না মানে---দাড়িয়ে পড়ে সোহান।
কি মানে মানে করছিস? কি হয়েছে তোর?বাথরুম থেকে ফিরে শুনব কি হয়েছে । ভেতরের রুমে ঢোকে অনীক।বিছানায় ব্যাগ আর মেয়েদের চাদর দেখে থমকে দাড়ায়। বাথরুমের দরজা বন্ধ পায়।
ফিরে আসে অনীক।কিরে তোর ভেতরের ঘরে মেয়েদের ব্যাগ ,চাদর।বাথরুম বন্ধ,কি ব্যাপার বন্ধু । আর তাই এত ইতস্তততা।
কি বলবে সোহান বুঝতে পারে না্। না মানে, না মানে---
হয়েছে আর না মানে, না মানে করতে হবে না।আমরা যাই এখন। তোদের বিরক্ত করে গেলাম।চলেন আমরা যাই,সঙ্গের লোকগুলোকে নিয়ে বের হতে নিয়ে পিছন ফিরে আস্তে করে বলে-দোস্ত ভালোইতো মজা করছিস ! নে চালিয়ে যা।
দরজা লাগাতে লাগাতে ভাবে সোহান,অনীক তার সম্পর্কে কি একটা বাজে ধারনা নিয়ে গেল।অনীক তার কলেজ বন্ধু।বন্ধুর কাছে সে এভাবে ছোট হয়ে গেল।এরপর লজ্জায় সে তার কাছে কিভাবে মুখ দেখাবে?
যে মিথ্যে ধারনা অনীক নিয়ে গেল সেটাই বা ভাঙ্গবে কি করে?
ভিতরের ঘরে আসে সোহান।বাথরুমের দরজায় শব্দ করে ।আসুন বের হন ওরা চলে গেছে।
আসুন ভয় নেই ওরা আর আসবে না।
ভিতর থেকে কোন সাড়া পায়না সে।
এইযে বের হন, ওরা চলে গেছে।
কোন সাড়া শব্দ নেই।
হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে সোহানের। লোকজনকে কি ডাকবে ? তাহলেতো আরো কেলেংকারী হবে।
লাথি দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলে।
অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠে -ওহ মাই গড!
রক্তে বাথরুমের মেঝে ভেসে যাচ্ছে।বাথমুমের মেঝেতে পড়ে আছে মেয়েটির রক্তাক্ত নিথর দেহখানা। তার হাতে রক্তমাখা ছুরি।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। মেয়েটির মৃতু্যর সাথে সাথেই তার কষ্টের মৃতু্য ঘটলেও শুরু হল অন্য এক নতুন অধ্যায়।
জেলখানার চার দেয়ালের মাঝে শুরু হল সোহানের কষ্টের এক নতুন উপাখ্যান।
হাজারো প্রশ্ন,হাজারো সন্দেহ এসে ভর করল সোহানকে ঘিরে।তার বাড়িতে মেয়েটির মৃতু্য।অবিবাহিত ছেলের কাছে মেয়েটির আসা,সেখানে মৃতু্য।হত্যা নাকি আত্মহত্যা ! সোহানের সাথে মেয়েটির কি সম্পর্ক,সাংবাদিক অনীকদের কাছে বিষয়টা লুকানো, অপ্রস্তুত হয়ে পড়া,এরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে চলতে থাকল তদন্ত ,প্রকাশিত হতে থাকল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।চলতে লাগল মামলা।জানেনা সোহান তার এ কষ্টের কবে পরিসমাপ্তি ঘটবে। সোহানের মত আমরাও জানিনা কবে তার কষ্ট থেকে মুক্তি মিলবে।